লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক দুর্গ। এটি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি–বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করে। মোগল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই কেল্লা শুধু ইতিহাসের সাক্ষী নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও গৌরবের প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত।
![]() |
লালবাগ কেল্লা |
লালবাগ কেল্লার ইতিহাস
লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে, মোগল সুবাদার প্রিন্স মোহাম্মদ আজমের নির্দেশে। তিনি ছিলেন মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র। পরে নবাব শায়েস্তা খাঁ ঢাকা অঞ্চলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং দুর্গের কাজের দায়িত্ব নেন। কিন্তু তার কন্যা পরী বিবির মৃত্যুর পর তিনি কেল্লার কাজ বন্ধ করে দেন।
ইতিহাসবিদদের মতে, নবাব শায়েস্তা খাঁ পরী বিবির মৃত্যুকে অশুভ লক্ষণ মনে করেছিলেন, তাই তিনি আর কেল্লার কাজ চালিয়ে যাননি। ফলে লালবাগ কেল্লা অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই রয়ে যায়। তবুও, এই অসম্পূর্ণ স্থাপনাটি আজও মোগল স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন।
স্থাপত্যশৈলী ও দর্শনীয় স্থান
লালবাগ কেল্লার মূল এলাকাটি প্রায় ১৮ একর জমির ওপর অবস্থিত। কেল্লার অভ্যন্তরে তিনটি প্রধান স্থাপনা রয়েছে—
-
দরবার হল (Diwan-i-Aam): এটি নবাবের প্রশাসনিক কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নিচতলায় ছিল গোপন সুড়ঙ্গপথ ও কারাগার।
-
পরী বিবির সমাধি: এটি সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত এক অপূর্ব সমাধিসৌধ। নবাব শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরী বিবি এখানে সমাহিত আছেন বলে ধারণা করা হয়।
-
বেগমপরি মসজিদ: তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটি মোগল স্থাপত্যকলার উজ্জ্বল উদাহরণ।
এছাড়াও, কেল্লার চারপাশে রয়েছে প্রশস্ত বাগান, পুকুর, ফোয়ারা ও পথঘাট। পুরো কেল্লা কমপ্লেক্সটি এক সময় রাজকীয় আবাস হিসেবে ব্যবহারের জন্য পরিকল্পিত ছিল।
লালবাগ কেল্লার সময়সূচী
লালবাগ কেল্লা সারাবছর খোলা থাকে, তবে নির্দিষ্ট দিনে এটি বন্ধ থাকে এবং খোলার সময় ঋতুভেদে কিছুটা পরিবর্তিত হয়।
গ্রীষ্মকাল (এপ্রিল–সেপ্টেম্বর):
-
খোলা থাকে: সকাল ১০:০০টা থেকে বিকেল ৬:০০টা পর্যন্ত
-
শুক্রবার: বিকেল ২:০০টা থেকে সন্ধ্যা ৭:০০টা পর্যন্ত
-
সাপ্তাহিক বন্ধ: রোববার পুরো দিন বন্ধ
শীতকাল (অক্টোবর–মার্চ):
-
খোলা থাকে: সকাল ৯:০০টা থেকে বিকেল ৫:০০টা পর্যন্ত
-
শুক্রবার: বিকেল ২:০০টা থেকে সন্ধ্যা ৬:০০টা পর্যন্ত
-
সাপ্তাহিক বন্ধ: রোববার পুরো দিন বন্ধ
অন্যান্য ছুটি:
সরকারি ছুটির দিন এবং বিশেষ ধর্মীয় দিবসে লালবাগ কেল্লা বন্ধ থাকতে পারে।প্রবেশমূল্য ও টিকিটের তথ্য
লালবাগ কেল্লায় প্রবেশের জন্য দর্শনার্থীদের একটি নির্দিষ্ট টিকিট ক্রয় করতে হয়। টিকিটের মূল্য নিচে দেওয়া হলো—
-
বাংলাদেশি প্রাপ্তবয়স্ক: ২০ টাকা
-
বাংলাদেশি শিক্ষার্থী: ১০ টাকা
-
বিদেশি পর্যটক: ২০০ টাকা
-
সাউথ এশিয়ান (SAARC) দেশসমূহের নাগরিক: ১০০ টাকা
-
ছোট শিশু (৫ বছরের নিচে): বিনামূল্যে
টিকিট ক্রয় স্থান:
কেল্লার প্রধান প্রবেশদ্বারের টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করা যায়। বর্তমানে অনলাইনে টিকিট বিক্রিরও ব্যবস্থা রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে।
দর্শনার্থী সুবিধা
লালবাগ কেল্লার ভেতরে রয়েছে প্রশস্ত হাঁটার রাস্তা, ছায়াঘেরা বাগান, বসার জায়গা ও একটি ছোট প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। এখানে মোগল আমলের অস্ত্র, পোশাক, মুদ্রা, অলঙ্কার, স্থাপত্য উপকরণ এবং ঐতিহাসিক দলিলপত্র সংরক্ষিত আছে।
পর্যটকদের সুবিধার্থে কেল্লার বাইরে খাবারের দোকান, বিশ্রামাগার এবং গাড়ি পার্কিংয়েরও ব্যবস্থা আছে।
রাতের দৃশ্য ও আলোকসজ্জা
সন্ধ্যা নামার পর লালবাগ কেল্লা আলোকিত হয়ে ওঠে। মনোমুগ্ধকর আলোকসজ্জায় পুরো দুর্গটি যেন জীবন্ত ইতিহাসের গল্প বলে। অনেক দর্শনার্থী শুধু এই রাতের দৃশ্য দেখতে আসেন, বিশেষ করে শীতের সন্ধ্যায় এটি এক ভিন্ন সৌন্দর্যে মোড়ানো থাকে।
কিভাবে যাবেন
লালবাগ কেল্লা ঢাকার আজিমপুর ও চকবাজার এলাকার মাঝখানে অবস্থিত।
-
বাসে: গুলিস্তান, আজিমপুর বা নিউ মার্কেট থেকে রিকশা বা সিএনজি করে সহজেই যাওয়া যায়।
-
ট্রেনে: কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে প্রায় ২০ মিনিটের রাস্তা।
-
গুগল ম্যাপে ঠিকানা: Lalbagh Fort, Lalbagh Rd, Dhaka 1211
উপসংহার
লালবাগ কেল্লা শুধু একটি দুর্গ নয়, এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের এক জীবন্ত নিদর্শন। ১৭ শতকের মোগল স্থাপত্যের জাঁকজমক আজও এই স্থাপনাকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। ঢাকায় ভ্রমণে গেলে লালবাগ কেল্লা ঘুরে দেখা মানে ইতিহাসের পথে একবার হাঁটতে যাওয়া।