মহাস্থানগড়: হারানো সভ্যতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি
বাংলার উত্তরভূমিতে, করতোয়া নদীর নিঃশব্দ স্রোতধারার পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ — মহাস্থানগড়। আজ এটি নিঃস্তব্ধ, কিন্তু একসময় এই নগরীর প্রাচীরের ভেতরে ছিল রাজনীতি, বাণিজ্য, ধর্ম, জ্ঞান আর সংস্কৃতির এক জীবন্ত কেন্দ্র। মহাস্থানগড় বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন পুরাকীর্তি। প্রসিদ্ধ এই নগরী ইতিহাসে পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রনগর নামেও পরিচিত ছিল।[১][২][৩] এক সময় মহাস্থানগড় বাংলার রাজধানী ছিল। যিশু খ্রিষ্টের জন্মেরও আগে অর্থাৎ প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল প্রত্নতাত্ত্বিক ভাবেই তার প্রমাণ মিলেছে। ২০১৬ সালে এটিকে সার্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
![]() |
| মহাস্থানগড় |
প্রাচীন পরিচয়
মহাস্থানগড়ের নাম একসময় ছিল পুন্ড্রনগর — পুন্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, যিশুখ্রিষ্টেরও বহু শতাব্দী আগে, এখানে গড়ে উঠেছিল এক উন্নত নগর সভ্যতা। এই নগরীতে ছিল রাজপ্রাসাদ, দুর্গ, দেবালয়, বিহার ও বাজার—যা প্রত্নতত্ত্বের পাতায় আজও বিস্ময়ের সৃষ্টি করে।
নামের গল্প
প্রাচীন কাহিনি বলে, করতোয়ার তীরে একদিন বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম তপস্যা করতে এসে এখানে সিদ্ধিলাভ করেন। তাঁর সেই তপস্যার স্থানই পরবর্তীতে পরিচিত হয় “মহাস্থান” নামে—অর্থাৎ “মহান স্থান”। পরবর্তীতে পুন্ড্ররাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হলে এই স্থানের নাম হয়ে যায় পুন্ড্রবর্ধন নগর। ইতিহাস মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি প্রাচীনতম প্রত্নতাত্ত্বিক নগরী। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে এটি পুণ্ড্র রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী ছিল। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে পুন্ড্রনগরে এসেছিলেন। ভ্রমণের ধারাবিবরণীতে তিনি তখনকার প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার উল্লেখ করে বর্ণনা দেন। বৌদ্ধ শিক্ষার জন্য প্রসিদ্ধ হওয়ায় চীন ও তিব্বত থেকে ভিক্ষুরা তখন মহাস্থানগড়ে আসতেন লেখাপড়া করতে৷ এরপর তারা বেরিয়ে পড়তেন দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। সেখানে গিয়ে তারা বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষার বিস্তার ঘটাতেন৷[৭] সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষ্মণসেন (১০৮২-১১২৫) যখন গৌড়ের রাজা ছিলেন তখন এই গড় অরক্ষিত ছিল। মহাস্থানের রাজা ছিলেন নল যার বিরোধ লেগে থাকত তার ভাই নীল এর সাথে। এসময় ভারতের দাক্ষিণাত্যের শ্রীক্ষেত্র নামক স্থান থেকে এক অভিশপ্ত ব্রাহ্মণ এখানে আসেন। তিনি রাজা পরশুরাম । এই রাজা পরশুরাম রাম নামে ও পরিচিত ছিলেন ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে আসেন ফকির বেশি দরবেশ হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (র:) এবং তার শীষ্য। ধর্ম প্রচারক শাহ্ সুলতান বলখী সম্পর্কে রয়েছে আশ্চর্য কিংবদন্তি।[৮] কথিত আছে, তিনি মহাস্থানগড় অর্থাৎ প্রাচীন পুন্ড্রনগরে প্রবেশ করার সময় করতোয়া নদী পার হয়েছিলেন একটা বিশাল মাছের আকৃতির নৌকার পিঠে চড়ে।
ইতিহাসের পৃষ্ঠা উল্টে দেখি
তৃতীয় খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চদশ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মহাস্থানগড় ছিল বাঙলার অন্যতম প্রাদেশিক রাজধানী। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন—প্রায় প্রতিটি শাসকবংশের পদচিহ্ন এখানে লিপিবদ্ধ।
চীনা ভ্রমণকারী হিউয়েন সাঙ ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে এসে এই নগরীর প্রশংসা করেছিলেন—যেখানে তিনি দেখেছিলেন শিক্ষা, ধর্ম ও বৌদ্ধ দর্শনের এক বিশাল কেন্দ্র। এখানকার বিহারগুলো থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা জ্ঞান ছড়িয়ে দিতেন চীন, তিব্বত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা প্রান্তে।
ইসলাম প্রচারের পদচিহ্ন
শতাব্দী পরে এখানে আসেন ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখী (রহ.)। লোককথায় আছে, তিনি করতোয়া নদী পাড়ি দেন এক বিশাল মাছের পিঠে চড়ে। তাঁর আগমন মহাস্থানগড়ের ধর্মীয় ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় যোগ করে—এখানে গড়ে ওঠে মুসলিম সাধনা ও সুফিবাদের ঐতিহ্য।
ভূগোল ও গঠন
মহাস্থানগড় বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে, বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু লাল মাটিতে অবস্থিত। এই স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩৬ মিটার উঁচু—যা প্রাচীন নগর প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল একদম উপযুক্ত। করতোয়া নদী ছিল নগরীর প্রাণ—যার তীরে জাহাজ ভিড়ত, চলত পণ্যবাণিজ্য।
প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার
১৮০৮ সালে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন প্রথম মহাস্থানগড়ের অবস্থান চিহ্নিত করেন। এরপর ১৮৭৯ সালে আলেকজান্ডার কানিংহাম প্রমাণ করেন যে এটি পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী। ১৯৩১ সালের খননকাজে পাওয়া যায় ব্রাহ্মী লিপি, যেখানে সম্রাট অশোকের আদেশে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষদের সাহায্যের কথা উল্লেখ আছে—যা প্রমাণ করে এই নগরীর মানবিক ও প্রশাসনিক উন্নততা।
দুর্গের রহস্য
মহাস্থানগড়ের দুর্গ এক আয়তাকার প্রাচীরবেষ্টিত শহর—দৈর্ঘ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার, প্রস্থে এক কিলোমিটারের বেশি। মাটির প্রাচীর, প্রবেশদ্বার, মন্দির, কূপ ও প্রাসাদ আজও সাক্ষ্য দেয় এক হারানো সভ্যতার।
উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোর মধ্যে আছে জিয়ত কুন্ড, মানকালীর ধাপ, পরশুরামের প্রাসাদ, বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দভিটা, খোদার পাথর ভিটা ইত্যাদি।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে মহাস্থানগড়ে রয়েছে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর, যেখানে সংরক্ষিত আছে হাজার বছরের ইতিহাসের স্পর্শ—মুদ্রা, মূর্তি, শিলালিপি, মাটির পাত্র, অস্ত্র ও স্থাপত্যের নিদর্শন। এখানকার নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন আজও ফিসফিস করে বলে—“আমি বাংলার অতীত।”
উপসংহার
মহাস্থানগড় শুধু ইট–মাটির ধ্বংসাবশেষ নয়, এটি সময়ের বুকে লেখা এক অমর ইতিহাস। এখানে মিলেছে বৌদ্ধ, হিন্দু ও ইসলামী সংস্কৃতির বন্ধন—যা বাংলাদেশের ঐতিহ্যের ভিত্তি।
আজও করতোয়ার হাওয়ায় যখন সন্ধ্যা নামে, তখন মনে হয়—এই গড়ের প্রাচীরের ভেতর এখনো বেঁচে আছে এক হারানো রাজ্য, এক মহান সভ্যতার নীরব কণ্ঠস্বর।
